বাড়ি পেয়েছেন সচ্ছলরা, ভাড়া থাকেন গৃহহীনরা!

গৃহহীনদের জন্য সরকারি বরাদ্দের বাড়ি নির্মাণের নামে ভূমি বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর আসনের সংসদ সদস্য ও বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হারুনুর রশিদের বিরুদ্ধে। বাড়ি বরাদ্দ পেতে ভূমিহীনদের নিজের জমি কিনতে বাধ্য করছেন এমপি হারুন। সংসদ সদস্যের কাছ থেকে জমি ক্রয়কারী ১৫ জনকে সরকারি বাড়ি বরাদ্দের জন্য ডিও লেটারের মাধ্যমে সুপারিশও করেছেন তিনি।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে টিআর-কাবিটা কর্মসূচির আওতায় সদর উপজেলার দক্ষিণ শহরে গৃহহীনদের জন্য ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২৫টি বাড়ি এবং ‘জমি আছে, ঘর নেই, নিজ জমিতে গৃহনির্মাণ’ কর্মসূচির আওতায় আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পে শল্লায় ১১টি বাড়ি নির্মাণ করে স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন। সুবিধাভোগীদের নিজ জমিতে বাড়ি নির্মাণের নির্দেশনা থাকলেও এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে এমপির জমি কেনার পর বাড়ি বরাদ্দ পেয়েছেন দিনমজুর ভিখু আলী।

তিনি জানান, আমি সরকারি খাস জমিতে বসবাস করতাম। এমপি হারুনের কাছ থেকে তিন কাঠা জমি কেনায় তিনি আমাকে সরকারি বাড়ি দিয়েছেন। ভিখুর স্ত্রী রোজিনা বেগম জানান, লোন করে নেওয়া ৭০ হাজার টাকা এবং গরু বিক্রি করে জমির দাম পরিশোধ করেছি। বাড়ি পেয়েছি, এখন পর্যন্ত জমির কাগজ পাইনি।

হানেফা খাতুন নামে অপর এক নারী জানান, রাস্তা পাশে খাসজমিতে থাকি। এনজিও থেকে লোন নিয়ে এক লাখ ৩০ হাজার টাকায় হারুন এমপির দুই কাঠা মাটি কিনেছি। বাড়ি দেওয়ার কথা বলে জমি দিয়েছে কিন্তু আমি এখনো বাড়ি পাইনি। দিলারা বেগম নামে অপর নারী জানান, পাশে সরকারি বাড়ি দেখিয়ে আমার কাছে দুই কাঠা জমি বিক্রি করেছে। বাড়ি দেওয়ার কথা, এখনো পাইনি। মজিবুর দালালের (ঠিকাদার) মাধ্যমে হারুন এমপির জমি কিনেছি।

টিআর-কাবিটা প্রকল্পে একই পরিবারকে দেওয়া হয়েছে পাঁচটি প্লট এবং চারটি বাড়ি। গৃহহীনদের জন্য সরকারি এসব বাড়ি পেয়েছেন বিত্তশালী ও সচ্ছলরা। সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে এসব বাড়িতে গৃহহীনরা থাকেন ঠিকই তবে ভাড়াটিয়া হিসেবে। কম মূল্যের এসব ধানী জমি প্লট হিসাবে বিক্রি করা হয়েছে উচ্চমূল্যে। বর্তমানে বসতি গড়ে ওঠায় বৃদ্ধি পেয়েছে জমির মূল্যও।

অনেক সচ্ছল ব্যক্তি সেকেন্ড হোম হিসাবে কিনেছেন এসব জমি। অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবী রেজাউল করিম রাজা জানান, মহিপুর মোড়ে আমার মার্কেটসহ দোতালা বাড়ি আছে। সেটা ছেড়ে আমি টিনের বাড়িতে থাকতে যাব কেন? এখানে আমার স্ত্রীর নামে জমি কিনেছি। পরে সরকারি বাড়ি পাওয়ায় তা মেয়ে-জামাইকে দিয়েছি। মাটি কেনায় হারুন এমপির দয়ায় বাড়িটা পেয়েছি।

এদিকে বেশ কয়েকটি বাড়ি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বাস্তবে যাদের কোনো অস্তিত্বই নেই। সেসব বাড়ির কয়েকটির সাইনবোর্ডও খুলে ফেলা হয়েছে। করসাজি করে ওইসব বাড়ি বিক্রি করে দেওয়ার অভিযোগও উঠেছে এমপি হারুনের ঘনিষ্ঠজন ঠিকাদার মজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে। মজিবুর নিজেও সরকারি বাড়ি পেয়েছেন।

সেন্টু আলী নামে এক পথ শ্রমিক মাসিক এক হাজার টাকা ভাড়ায় আছেন মাহফুজা নামে একজনের বাড়িতে। তবে স্থানীয়রা জানান, মাহফুজা নামে এখানে কেউ কখনো ছিল না। বর্তমানে সেই বাড়ির মালিক বাবু নামে এক ব্যক্তি। তার সঙ্গে কথা হয় মুঠোফোনে। তিনি জানান, তার বাড়িতে কেউ ভাড়া থাকে না। সেখানে তার এক খালা থাকেন। শহরের উদয়ন মোড়ের একাধিক ইলেকট্রনিক্স শো-রুমের মালিক আরশাদ আলী আসাদ।

তিনিও স্ত্রীর নামে বাড়ি কিনে ভাড়া দিয়েছেন। প্রতিবন্ধী হোটেল শ্রমিক মাহবুব ও তার স্ত্রী আম্বিয়া থাকেন একটি বাড়িতে। তারা জানান, ঠিকাদার মজিবুর চারটি বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছে। আমাদের বাড়ি দিব বলে জমি বিক্রি করেছে। বাড়ি না দেওয়ায় এই বাড়িতে আমাদের রেখেছে ঠিকাদার মজিবুর। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাড়িটি অন্য একজনের নামে প্রথমে বরাদ্দ নেওয়া হয়। পরে কারসাজি করে সেই বাড়ি আরেকজনের নিকট বিক্রি করে দিয়েছেন ঠিকাদার মজিবুর।

এ বিষয়ে প্রথমে ক্রেতা সেজে মোবাইলে জমি কেনার প্রস্তাব দিলে ঠিকাদার মজিবুর জানান, জমি দেওয়া যাবে, তবে এই মুহূর্তে সরকারি বাড়ি দেওয়া যাবে না। এমপি হারুনের বরাত দিয়ে তিনি জানান, সরকারি বাড়ির নতুন বরাদ্দ এলে বাড়ি দিব। পরে সাংবাদিক পরিচয়ে তার কাছে গেলে তিনি সব বিষয় অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, আমার নামে কোনো বাড়ি নেই। তবে অফিসের জন্য আমার ছেলের নামে একটি বাড়ি পেয়েছি।

সদর উপজেলার প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মওদুদ আলম খাঁ প্রকল্পের কোনো তথ্য দিতে অপরাগতা জানিয়ে বলেন, ইউএনও স্যারকে আমি বলেছিলাম, তিনি বলেছেন তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে। তিনি না বললে তো আমি তথ্য দিতে পারব না। সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমুল ইসলাম সরকারের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি এ বিষয়ে সংবাদ না করার পরামর্শ দিয়ে বলেন,

আমি আপনাদের চাঁপাইকে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ বানিয়েছি, এটা চিন্তা কইরেন। ১০ জনের কথার পেছনে না দৌড়িয়ে আমি যেটা বলব সেটা করেন যাতে ফার্স্ট (প্রথম) হতে পারেন। আর যদি নিউজ করেন তাহলে আমি সব বন্ধ করে দিব। চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য হারুনুর রশিদ জানান, আমি মাটির ব্যবসায়ী নই,

দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে এসব উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। এগুলো আমার পৈতৃক জমি। অত্যন্ত স্বল্পমূল্যে আমি জমিগুলো বিক্রি করেছি। আর এসব কাজ করতে গেলে কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি হবেই, এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এসব দরিদ্র মানুষ যাতে সেখানে গিয়ে একটি সুন্দর পরিবেশ পায়, সেটিই আমার উদ্দেশ্য।